ডিজিটাল স্বাস্থ্য: রিমোট পেশেন্ট মনিটর সিস্টেম

ছেলেবেলা থেকেই মিলি দেখছে যে তার দাদার ডায়াবেটিক আছে। যদিও তার দাদুকে ইনসুলিন নিতে হয়না কিন্তু কিছুদিন পর পরেই তার রক্তের গ্রুকোজের পরিমান মাপতে হয়। তারা মফস্বলে থাকে বলে একটু দূরের বড় রাস্তার মোড়ে যেয়ে একটি ফর্মেসিতে যেয়ে মিলির দাদু এটি করে আসেন। গ্রুকোজের পরিমান বেড়ে গেলে ডাক্তারের কাজে যেতে হয়। ছেলেবেলা থেকেই মিলি দাদুর এই ব্যাপারটির সাথে পরিচিত। কিন্তু মিলি এখন অনেক বড় হয়েছে আর সাথে সাথে তার দাদুরও বয়সে হয়েছে। দূরের রাস্তার মোড়ে যাওয়া দাদুর জন‍্য একটু কষ্টকর ব‍্যাপার হয়েছে। মিলি ভার্সিটিতে যাবার সময় রিকশাতে করে ফার্মেসিতে নিয়ে যায়। কিন্তু গত সপ্তাহে দাদু ডাক্তারের কাছ থেকে একটি মজার যন্ত্র পেয়েছে যা দিয়ে ঘরে বসেই গ্রুকোজ মাপা যাবে, আর সেই দাদুর ডাক্তার হাসপাতালে বসেই দাদুর ডায়েবেটিকের অবস্থা জানতে পারবে। মিলি প্রথম এই যন্ত্রটির নাম শুনল – বিদঘুটে নাম , রিমোট পেশেন্ট মনিটর সিস্টেম ।

রিমোট পেশেন্ট মনিটর সিস্টেম কি?

রিমোট পেশেন্ট মনিটর সিস্টেম এর বাংলা অনুবাদ করলে হবে – দূরবর্তী কোন রোগী কে পর্যবেক্ষণ করার যন্ত্র। সাধারণ কোন অসুখের ক্ষেত্রে ডাক্তারের চেম্বারে যেয়ে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়ার প্রয়োজন হয়। কিন্তু কিছু কিছু অসুখের ক্ষেত্রে ডাক্তার এর কাছে না যেয়ে, অসুখিটি মনিটর করার প্রয়োজন হয়। এই অসুখগুলোকে ক্রনিক বা দীর্ঘমেয়াদী অসুখ বলে। হটাৎ করে এগুলো সারান যায়না কিন্তু মনিটর করার প্রয়োজন হয়। যেমন, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিক। রিমোট পেশেন্ট মনিটর সিস্টেমের মাধ্যমে রোগী ঘরে বসে তার রিপোর্টগুলো ডাক্তারকে পাঠাতে পারেন। ডাক্তার সেই রিপোর্ট গুলি মনিটর করেন এবং কোন সাজেশন থাকলে তা সেই সিস্টেমের মাধ্যমে রোগীকে দিতে পারেন।

এছাড়াও প্রত্যন্ত অঞ্চল- যেখানে একজন রোগীর পক্ষে ডাক্তারের কাছে যাওয়াটা সম্ভব হয়না সেরকম জায়গাতেই এই রিমোট পেশেন্ট মনিটরিং সিস্টেম ব্যবহৃত হয়। পঙ্গু বা বার্ধক্য জনিত কারণে অনেক রোগীরা হাসপাতালে আসতে পারেন না। তাদের জন‍্য এই রিমোট পেশেন্ট মনিটর সিস্টেম অনেক সাহায্য করতে পারে।

রিমোট পেশেন্ট মনিটর সিস্টেমে সাধারণত রক্তচাপ, শরীরের ওজন, রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ মাপার যন্ত্র সংযুক্ত থাকে। যন্ত্রগুলো দিয়ে কোন রিডিং নিলে বা পরিমাপ নিলে রিপোর্টগুলো সয়ংক্রিয়ভাবে ডাক্তারের কাছে চলে যায়। এছাড়াও আরো নতুন কিছু সেন্সর এই সিস্টেমের সাথে সংযুক্ত হচ্ছে। যেমন, বয়ষ্ক মানুষদের মবিলিটি বা ঘরের ভিতর চলাফেরা করছে কিনা। আমাদের দেশে না হলেও বিদেশে অনেক বয়স্ক লোকজন শহর থেকে দূরে তাদের বাড়িতে থাকে। অনেক সময় বাড়ির আশেপাশে কেউই থাকেনা। যদি বাড়ির ভিতর তাদের চলাফেরা না হয় তবে তা সয়ংক্রিয়ভাবে তার ছেলে-মেয়েদের কাছে মোবাইলে জানিয়ে দিবে কোন বিপদ হল কিনা।

ক্রনিক রোগে অসুস্থরা ছাড়াও স্বাস্থ্য সচেতনরা এই যন্ত্রের প্রতি খুব আগ্রহ দেখাচ্ছে। মনিটর করে দেখছে তাদের সবকিছু স্বাভাবিক আছে কিনা। সাধারণত বার্ধক্য জনিত রোগ বা বয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে এই সিস্টেম বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে। যেমন জাপান এবং আমেরিকাতে এর প্রয়োগ আমরা গত ১০ বছর ধরে এর ব্যবহার বাড়তে দেখছি।

রিমোট পেশেন্ট মনিটর সিস্টেম বাংলাদেশের মত দেশেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কেননা রিমোট পেশেন্ট মনিটর সিস্টেম ব্যাবহার করলে হাসপাতালে রোগীদের চাপ অনেকাংশে কমবে। ক্রনিক রোগীদের একটা বড় অংশ বাসা থেকেই তার তথ্য হাসপাতালে পাঠাতে পারে বলে রোগীদের সরাসরি হাসপাতালে আসার প্রয়োজন হয় না।

কিছুদিন আগে এক ডাক্তারের সাথে এই বিষয়ে কথা হচ্ছিল। ডাক্তার অবশ্যই রোগীর রোগ নির্ণয় করে তার সেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বেশি সচেতন। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চায় কিভাবে হাসপাতালে রোগীর চাপ কমানো যায়। বিশেষ করে সরকারি বা কেন্দ্রীয় হাসপাতালগুলোতে প্রচুর রোগী আসে যার একটি বড় অংশই হল দীর্ঘমেয়াদী অসুস্থ লোকজন। যেহেতু ক্রনিক ডিজিজের রোগীদের সংখ্যা নেহায়তই কম নয়, আর তারা ঘরে বসেই এই চিকিৎসা সেবা নিতে পারবেন, ফলে রোগীর চাপ মূল হাসপাতালে কমে যাবে।

রিমোট পেশেন্ট মনিটর সিস্টেমের আর একটি প্রয়োগ হল বৃদ্ধাশ্রম বা ওল্ডহাম এ, যেখানে বয়স্কদের সেবা শশ্রুষা করা হয় যা বাসা থেকে করা সম্ভব নয়। এখানে সাধারণত নার্সরাই বয়স্কদের দেখাশোনা করে থাকেন। নার্সরা নিয়মিত বয়স্কদের ওজন, রক্তচাপ সহ আনুসঙ্গিক তথ্যগুলোকে লিপিবদ্ধ করে ডাক্তারের কাছে পাঠিয়ে থাকেন। বেশীরভাগ সময় ব্যাপারটি ম্যানুয়াল বা সনাতন কাগজ কলমে করা হয়ে থাকে। কিন্তু অত্যাধুনিক এই রিমোট পেশেন্ট মনিটর সিস্টেম ব্যবহার করে ডাক্তাররা দূর থেকে তাদের রোগীদের পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন।

ভবিষ‍্যতের রিমোট পেশেন্ট মনিটর সিস্টেম:

রিমোট পেশেন্ট মনিটর সিস্টেমে এখন পর্যন্ত সাধারণ তথ্য বা সেন্সর থেকে প্রাপ্ত তথ্য হাসপাতালে পাঠানোর একটা সিস্টেম। এই তথ্য গুলো সাধারণত একজন ডাক্তার বা অভিজ্ঞ নার্সরা (যাদের আমরা কেয়ার প্রভাইডার বলি) তারাই তথ্যগুলো কে পর্যবেক্ষন করে সিদ্ধান্তে নেন। রোগীকে কোন গুরুত্বপূর্ণ কিছু জানানোর প্রয়োজন হলে, ডাক্তার বা নার্স সরাসরি রোগীর সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।

কিন্তু আমরা এখন রিমোট পেশেন্ট মনিটর সিস্টেমের ২য় ধাপ দেখতে পাচ্ছি। এই ২য় ধাপে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ হচ্ছে। অর্থাৎ এই ধাপে সেন্সর থেকে প্রাপ্ত তথ্য ডাক্তারের কাছে পাঠাবে। পাশাপাশি আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স এই তথ্যগুলোকে পর্যবেক্ষণ করে দেখবে এতে কোন সন্দেহজনক বা গুরুত্বপূর্ণ কিছু রয়েছে কিনা যা ডাক্তারের নজরে আসা দরকার। যদি অস্বাভাবিক তথ্য পাওয়া যায় তখন আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে ডাক্তার কে জানাতে পারে এবং ডাক্তারকে সহায়তা করতে পারবে। যেমন, উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের ক্ষেত্রে হটাৎ উচ্চ রক্তচাপের রিডিং পাওয়া গেলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিজে থেকেই সতর্ক করবার খবরটি ব্যবহারকারির কাছে পাঠাবে।

এখন পর্যন্ত আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স শুধু সহায়ক হিসেবেই কাজ করছে , অদূর ভবিষ্যতে আমরা দেখব হয়ত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিজেই কোন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে এবং প্রয়োজন হলে অন্যান্য কাজ গুলো ও করে দিচ্ছে। যেমন একজন ডায়াবেটিক রোগীর ডায়াবেটিক স্ট্রিপ প্রায় শেষের দিকে, তখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ডায়াবেটিক স্ট্রিপ এর অর্ডার নিজেই দিয়ে দিবে। ই-কমার্সের মাধ্যমে তা পৌছে যাবে আমাদের ঘরের দুয়ারে।

চিকিৎসা সেবা ঘরে বসে পাবার অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এই রিমোট পেশেন্ট মনিটর সিস্টেম এবং আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স। স্বাগতম এই নতুন প্রযুক্তির দুয়ারে। মিলির দাদুদেরকে আর কষ্ট করে হাসপাতালে যেতে হবেনা। ঘরে বসেই তারা তাদের কাজগুলো সেরে নিতে পারবে।

তথ্যসূত্র:

● 19 million will use remote patient monitoring by 2018 : https://www.getrealhealth.com/publications-media/med-city-news-report-19-million-will-use-remote-patient-monitoring-by-2018/

● Wikipedia Remote patient monitoring https://en.wikipedia.org/wiki/Remote_patient_monitoring

● http://connhealth.com/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are makes.