ম্যাডাম ক্যুরীর জন্মদিনে ~ অভিজিৎ মজুমদার

গল্পটার শুরু প্রায় দেড়শ বছর আগে। ১৮৬৭ সালের ৭ই নভেম্বর, রাশিয়া প্রভাবিত পোল্যান্ডের ওয়ারশ শহরে জন্ম হল পাঁচভাইবোনের মধ্যে সবথেকে ছোটো মারিয়া স্কলদোয়াস্কার। মারিয়ার প্রথমদিকের পড়াশোনা হল বাড়িতে বাবা-মায়ের কাছে আর স্থানীয় স্কুলে। বাবা-মা দুজনেই স্কুল টিচার। তাই বাড়িতে পড়াশনোর আবহাওয়াটা এমনিতেই ছিল। ফলতঃ মারিয়া যে স্কুলে খুব ভালো ফল করবে তাতে আর আশ্চর্যের কি আছে?  কিন্তু গোল বাঁধল একটু বড় হতেই। ওয়ারশতে যে কোনও মেয়েদের ইউনিভার্সিটি নেই। যেটি আছে, সেখানে তো মেয়েদের প্রবেশ নিষেধ। অতএব উপায়? কথায় বলে যার ইচ্ছা থাকে সে নিজের রাস্তা নিজেই খুঁজে নেয়।  মারিয়াও তাই করল। ও ওর পড়াশুনো শুরু করল শহরের “ফ্লোটিং ইউনিভারসিটি”তে। এখানে পড়াশুনা করা হত গোপনে, যেন কোনো অপরাধ করা হচ্ছে। অবশ্য সেই সময়ে মেয়েদের ইউনিভারসিটিতে পড়াশুনো করা অপরাধের থেকে কম কিসে?
কিন্তু “ফ্লোটিং ইউনিভারসিটি”তে পড়ে মারিয়ার পড়াশুনো করার তৃষ্ণা মিটল না। ও চাইল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যা মেয়েদের জন্য তখনকার দিনে পাওয়া যেতে পারত প্যারিসে।  ততদিনে মারিয়ার মা মারা গেছেন। মারিয়াকে প্যারিসে পড়াশুনোর জন্য পাঠানোর মত অর্থ ওর গরীব বাবার  কাছে ছিল না। কিন্তু চিরলড়াকু অথচ শান্ত মারিয়া হার মানল না। পাঁচ বছর ধরে গভর্নেস আর টিউটরের কাজ করে টাকা যোগাড় করল ও। এরই ফাঁকে ফাঁকে নিজের মনের খোরাক হিসেবে চলতে লাগল ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি আর অংকের পাঠ। তারপর টাকাপয়সা জমিয়ে একদিন ও পাড়ি দিল প্যারিস, বহু মনন আর মনীষার রাজধানী পারী। সেটা ১৮৯১ সাল। প্যারিসে এসে  মারিয়া যোগ দিল বিখ্যাত সর্বন ইউনিভারসিটিতে।  ভরতি তো হল কিন্তু প্যারিসে জীবনধারনে অর্থসংস্থান কোথায়? চা আর পাঁউরুটি খেয়ে দিন কাটাতে লাগল বছর চব্বিশের মারিয়া। তবু হাল ছাড়ল না মেয়ে। ১৮৯৩ তে ফিজিক্স আর তার পরের বছর গণিতে ডিগ্রী নিয়ে সসম্মানে পাশ করল সে। এই সময়েই তার সঙ্গে দেখা হল তার জীবনসঙ্গীর, নিতান্তই কাজের সূত্রে। কিন্তু একে অপরের মেধার হীরকদ্যুতিতে আকৃষ্ট হতে দেরি হল না। ১৮৯৫-তে বিয়ে হল পিয়ের ক্যুরি আর মারিয়া  স্কলদোয়াস্কার যাকে এর পর থেকে আমরা চিনব মাদাম মেরি ক্যুরি নামে। বিজ্ঞানের জগতে এ যেন এক রূপকথার বিয়ে। জুটি বাঁধার মাত্র আট বছরের মাথায় যদি স্বামী-স্ত্রীর একসাথে নোবেল প্রাইজ পান, তাকে রূপকথা ছাড়া আর কিই বা বলা যেতে পারে?  তবে তার আগেই ১৯০০ সালে মাদাম ক্যুরি যোগ দিয়েছেন ইকোল নরমাল সুপিরিয়র-এ, ফিজিক্সের লেকচারার হিসেবে।  একবার নয়, দুবার নয়, তিন তিনবার (১৮৯৮, ১৯০০ এবং ১৯০২ সালে) পেয়েছেন ফ্রেঞ্চ বিজ্ঞান আকাদেমির গেগনার প্রাইজ। ১৯০৩ সালে পেয়েছেন ডক্টর অফ ফিজিকাল সায়েন্স ডিগ্রী। পেয়েছেন ফ্রান্সের বারথলট মেডেল।কিন্তু প্রতি পদক্ষেপেই তাঁকে লড়াই করতে হয়েছে সমকালীন লিঙ্গবৈষম্যের বিরূদ্ধে।যেমন, তাঁর নিজের গেগনার পুরস্কার প্রাপ্তির খবর তাঁর কাছে না পাঠিয়ে ফ্রেঞ্চ আকাদেমি পাঠিয়েছে তাঁর স্বামী পিয়ের ক্যুরির কাছে। তবে এই সব কিছুর জবাব মেরি দিয়েছেন তাঁর কাজের মধ্যে দিয়ে।  তার স্বীকৃতি হিসেবে ইংল্যন্ড রয়াল সোসাইটি থেকে পেয়েছেন হাম্ফ্রে ডেভি মেডেল। আর নোবেল প্রাইজ তো আছেই।  তেজষ্ক্রিয়তা নিয়ে  তাঁর কাজের জন্য ১৯০৩ সালে মাদাম ক্যুরি  পদার্থবিদ্যায় নোবেল প্রাইজ পেলেন, স্বামী  পিয়ের ক্যুরি এবং আরেক ফরাসি বিজ্ঞানী বেকারেল-এর সাথে যৌথভাবে। বেকারেল দেখিয়েছিলেন যে ইউরেনিয়াম থেকে এক প্রকার বিকিরন হয় যা এক্সরের থেকেও মৃদু। ক্যুরি দম্পতি  সেই বিকিরণের নাম দিলেন রেডিওঅ্যাক্টিভিটি।  তাঁরা দেখালেন যে এই তেজষ্ক্রিয়তা ইউরেনিয়ামের একটি মৌলিক ধর্ম যা কিনা পারমাণবিক গঠন থেকে উদ্ভুত।  সেই সময়ের হিসেবে এ ছিল এক যুগান্তকারী ধারণা। তারই সাথে সাথে রচিত হয়েছিল আরেকটি  যুগান্তকারী ইতিহাস। সেই প্রথম কোনও নারীর হাতে উঠল সাহিত্য-শান্তি-বিজ্ঞানের এই সর্বোচ্চ সম্মান। ক্যুরি নোবেল পেয়ে সম্মানিত হলেন, না নোবেলপদক ক্যুরিকে পেয়ে তার এতদিনের পুরুষতন্ত্রের কলঙ্কমোচন করল, কে বলতে পারে? কিন্তু কে না জানে, রূপকথারা বাস্তবে দীর্ঘস্থায়ী হয় না। যুগ্ম নোবেলের মাত্র তিন বছরের মাথায় পথ দুর্ঘটনায় মারা গেলেন পিয়ের। ব্যক্তিগত শোক কাটিয়ে পিয়েরের ছেড়ে যাওয়া পদ গ্রহন করলেন মেরী। তিনি হলেন সর্বন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা অধ্যাপক। বিজ্ঞানে জেন্ডার ইক্যুয়ালিটির ইতিহাসে যোগ হল আরেকটি ধাপ। এর পাঁচ বছরের মাথায়, ১৯১১ সালে, মেরী পেলেন তাঁর দ্বিতীয় নোবেল, রোডিয়াম আর পোলোনিয়াম আবিষ্কারের জন্য। তবে এইবার রসায়নে। এবং একলা। তাঁর নোবেল ভাষণে এই সম্মান স্বর্গত স্বামীর সাথে ভাগ করে নিলেন মেরী। এইবার দুটি রেকর্ড স্থাপন করলেন মাদাম ক্যুরি। এক, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রথমবার দুবার নোবেল পাওয়ার কৃতিত্ব আর বিজ্ঞানের দুটি বিভাগে নোবেল প্রাইজ পাওয়ার কৃতিত্ব। এই দ্বিতীয় রেকর্ডটি এখনও অক্ষত আছে। ১৯১৪-তে শুরু হল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। বিশ্ব-রাজনীতির এই টালমাটাল সময়ে নিজের বিজ্ঞানের গজদন্তমিনারে বসে রইলেন না ক্যুরি। নিজের অর্থ ও সময় নিযুক্ত করলেন মানুষের সাহায্যে। ক্যুরির তৈরি পোর্টেবল এক্স-রে মেশিন পৌঁছে গেল যুদ্ধক্ষেত্রে। তা এতই জনপ্রয় হল যে সেই যন্ত্রের নামই হয়ে গেল “লিটল ক্যুরি”।যুদ্ধ থামলেও মাদাম ক্যুরির কাজ কমল না। তিনি তাঁর সময় এবার নিয়োগ করলেন ওয়ারশতে রেডিয়াম রিসার্চ ইন্সটিটিউট গড়ে তোলার কাজে। তাঁর খ্যাতি কাজে লাগল প্রয়োজনীয় অর্থ-সংগ্রহে। ১৯২১ সালে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট হার্ডিঞ্জ সমগ্র আমেরিকার নারীজাতির পক্ষ থেকে মাদাম ক্যুরিকে উপহার দিলেন এক গ্রাম রেডিয়াম। ১৯২৯ সালে তৎকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট হোভার তাঁকে উপহার দিলেন পঞ্চাশ হাজার মার্কিন ডলার, তাঁর গবেষণাগারে রেডিয়াম কেনার জন্য। কিন্তু অবিশ্রাম পরিশ্রম আর ক্রমাগত তেজষ্ক্রিয় বিকরণের মধ্যে থাকার প্রভাবে ১৯৩৪ সালে সাতষট্টি বছর  বয়সে এপ্লাস্টিক এনিমিয়ায় চলে গেলেন মাদাম ক্যুরি। কিন্তু রূপকথারা শেষ হয় না। তাই শুধু জীবনেই নয়, মৃত্যুর বহুবছর বাদে এখনও বিজ্ঞানের সাম্রাজ্ঞী মাদাম ক্যুরি প্রতিষ্ঠা করে চলেছেন নারী-পুরুষের সমানাধিকার। যেমন ধরা যাক, প্যারিসের প্যান্থেয়ন, যা কিনা ফ্রান্সের চিন্তাজগতের অগ্রাধিনায়কদের সমাধিস্থল, ১৯৯৫ সালে প্রথম নারী হিসেবে সেখানে প্রবেশ করেছেন মাদাম ক্যুরি। মৃত্যুর পরও জারী রয়েছে তাঁর জয়যাত্রা। যতদিন এই পৃথিবীতে লিঙ্গবৈষম্য থাকবে, ততদিন মাদাম মারিয়া স্কলদোয়াস্কা ক্যুরি নীল আকাশের বুকে উড়তে থাকবেন সমানাধিকারের  জয়পতাকা হিসেবে।
*****
এই লেখাটা লিখেছিলাম বেশ কয়েক বছর আগে। কেউ একটা নিয়েওছিল ছাপবে বলে। কিন্তু কাকে দিয়েছিলাম আর ছাপা হয়েছিল কি না, সে আমার জানা নেই। তাই এখানে দিলাম আরেকবার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are makes.