Coronavirus (কোরোনা ভাইরাস)

২০০২ সাল, একটি হোটেলের সকল অতিথি জানতেও পারলেন না যে তারা সকলে এক অপরিচিত ভাইরাসের হোস্ট বা বাহক হয়ে গেছেন। সেই ভাইরাসের করাল গ্রাসে ছয় মাসে ৭৭৪ জনের মৃত্যু হয়। বিপর্যস্ত হয়েছিল অর্থনীতি। এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাঙ্ক-এ ঐ ক্ষতির পরিমাণ ৫৯ বিলিয়ন মার্কিন-ডলার। ভাইরাসটির নাম দেওয়া হয়েছিল “সিভিয়র্ অ্যাকিউট্ রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম কোরোনাভাইরাস”(সার্স-কভ্)  কারণ রোগটি পরিচিত হয়েছিল “সিভিয়র্ অ্যাকিউট্ রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম” নামে। ওখানেই শেষ নয়। কয়েক বছর পর সৌদি আরবে “মিড্ল ইস্ট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম কোরোনাভাইরাস”(মার্স-কভ্)-র তাণ্ডব আছড়ে পড়ে। জানা যায় যে মার্স-কভ্ ভাইরাসটি সার্স-কভ্-র সাথে সম্পর্কযুক্ত ও তার ফলে নিমেষে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে কারণ পৃথিবী ইতিমধ্যে সার্স-কভ্-র ভয়াবহতা দেখেছিল। যদিও পরে “এপিডেমিওলজিকাল রিপোর্ট” বা “মহামারী পরিসংখ্যান সংক্রান্ত প্রতিবেদন” অনুযায়ী বোঝা গিয়েছিল যে মার্স-কভ্ সৃষ্ট ছোঁয়াচে শ্বাসরোগের ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা সার্স-কভ্ অপেক্ষা কম। কিন্তু তাহলেও সার্স-কভ্ এর মত মার্স-কভ্ এর কুপ্রভাব পড়েছিল সমস্ত পৃথিবীর উপর। পৃথিবীর সংক্রমিত অঞ্চলগুলির সাথে বাকি অঞ্চলগুলির যাতায়াতে বহু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল।

২০১৯ সাল, ডিসেম্বর মাসের শেষের দিক, উহান নগর, চীন:

মানুষ অসুস্থ শরীরে ডাক্তারখানার কড়া নাড়তে শুরু করলেন; উপসর্গ – জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট ও পেশীতে ব্যাথা। ডাক্তারেরা জানিয়েছিলেন – “ভাইরাল বাইল্যাটারাল নিউমোনিয়া” (অর্থাৎ দুটি ফুসফুসই ভাইরাস ঘটিত নিউমোনিয়া-য় আক্রান্ত)। কিন্তু কিছু সময়ের মধ্যেই সেই নিউমোনিয়া ডাক্তারদের কপালে ভাঁজ ফেলল কারণ অসুস্থ মানুষের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলেছিল। রোগের কার্য-কারণের গভীর তলদেশে পাড়ি দিয়ে ডাক্তারেরা বুঝতে পারলেন যে নিউমোনিয়ার ছদ্মবেশে এক নতুন রোগ রোগীর ফুসফুস বেয়ে গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল অঙ্গসমূহের দিকে গুটি গুটি নেমে আসছে। ২০০২ সালে মানবজাতির উপর “সার্স-কভ্” ভাইরাসের ভয়াবহ আক্রমণের প্রায় সতেরো বছর পর পুনরায় মানুষের শ্বাসতন্ত্রে দেখা মিলল এমন এক ক্ষতিকারক ভাইরাস যার সাথে মানুষের এর আগে পরিচয় হয়নি।

বোঝা গেল যে শ্রেণীবিন্যাস বা ট্যাক্সনমি অনুযায়ী ভাইরাসটি “নিডোভাইরেল্স” অর্ডার অন্তর্ভুক্ত। ভাইরাসটির জেনেটিক উপাদান “আর.এন্.এ.” বা “রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড” হলেও আমাদের বহু পরিচিত আর.এন্.এ. ভাইরাসগুলির (যেমন : এইচ্.আই.ভি. বা হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস) মত এটি নিজের “আর.এন্.এ.” কে “ডি.এন্.এ.” বা “ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড”-এ পরিবর্তিত করে মানুষের কোষের “ডি.এন্.এ.”-তে তা মিশিয়ে দেয় না। বরং, এই ভাইরাস মানুষের কোষে প্রবেশ করার পর মানবকোষের নিজস্ব “বার্তাবহ  আর.এন্.এ.”(মেসেঞ্জার  আর.এন্.এ.)-কে নিষ্ক্রিয় করে দিয়ে নিজের “আর.এন্.এ.” কে মানবকোষের “বার্তাবহ আর.এন্.এ.”-র ভূমিকায় লাগিয়ে দেয়। আর মানবকোষের “রাইবোজোম” অঙ্গাণুটি কিছু টের না পেয়ে ভাইরাসের সেই “বার্তাবহ  আর.এন্.এ.”-র নিউক্লিয়টাইড ক্রমকে অনুসরণ করেই দুই প্রকার পলিপ্রোটিন (পলিপ্রোটিন অণু হলো অনেকগুলি অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের প্রোটিন অণু একে অপরের সাথে সমযোজী বন্ধনের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে তৈরি হওয়া একটি দীর্ঘ শৃঙ্খলের মত অণু) তৈরি করে ফেলে। এদের মধ্যে একপ্রকার পলিপ্রোটিন ভেঙে গিয়ে যে ষোলো প্রকার “ননস্ট্রাক্চারাল প্রোটিন”(যে প্রোটিন কোষের গঠন নয় বরং কোষের কার্যকারিতায় সাহায্য করে) তৈরি হয় তাদের মধ্যে কিছু প্রোটিন এমন আছে যারা ভাইরাসটির “আর.এন্.এ.”কে অনুকরণ করে “ট্রান্সক্রিপ্শন্”(ভাইরাসটির “আর.এন্.এ.”-তে নিউক্লিয়টাইডগুলি ঠিক কি ক্রমে আছে তা কপি করে নেওয়ার প্রক্রিয়া হলো ট্রান্সক্রিপ্শন্) ও “রেপ্লিকেশন্”(কপি করে নেওয়া নিউক্লিয়টাইড ক্রম অনুযায়ী নতুন “আর.এন্.এ.” তৈরি করার প্রক্রিয়াকে রেপ্লিকেশন্ বলে) প্রক্রিয়ায় আরও অনেক ভাইরাস জন্ম দেওয়ার জন্য দরকারি অনেকগুলি “আর.এন্.এ.” হুবহু তৈরি করে দেয় – অর্থাৎ অবলীলাক্রমে ভাইরাসটি মানুষের কোষের মধ্যেই নিজের বংশবিস্তারের পথটা সুপ্রশস্ত করে নেয়।

এই ভাইরাসের প্রকোপে মানুষের হওয়া নতুন ছোঁয়াচে রোগটির নাম দেওয়া হলো – “কোরোনা ভাইরাস ডিজিজ – ২০১৯” বা “কোভিড – ১৯” যা পৃথিবী জুড়ে মৃত্যুর তাণ্ডবলীলা চালাচ্ছে, পৃথিবীর অর্থনীতি ঠেকেছে তলানিতে। যে চার প্রকার প্রোটিন নিয়ে ভাইরাস কণাটি তৈরি হয়েছে, তাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো “স্পাইক প্রোটিন”। একে “স্পাইক প্রোটিন” বলার কারণ হলো এই প্রোটিন ভাইরাস কণাটির সারা গায়ে “স্পাইক” বা “কাঁটা”-র মত অজস্র উপাংশ তৈরি করে যাদের মাইক্রোস্কোপে দেখতে লাগে ঠিক যেন “উজ্জ্বল সূর্যকে ঘিরে থাকা আভা” বা “সোলার কোরোনা”।

এই দৃশ্য বিজ্ঞানীদের নিশ্চিত করে দিয়েছিল যে ভাইরাসটি “কোরোনাভিরিডে” ফ্যামিলি-র একজন। এই প্রথম মানবসভ্যতার গোচরে আসায় ভাইরাসটির নাম দেওয়া হয়েছিল “নভেল কোরোনা ভাইরাস” বা “নতুন জাতের কোরোনা ভাইরাস”। তবে “সার্স কভ্” ভাইরাসের “আর.এন্.এ.”-র নিউক্লিয়টাইড সিকোয়েন্স বা ক্রমের সাথে এই ভাইরাসের সত্তর শতাংশ সাদৃশ্য থাকায় এবং “সার্স কভ্” ভাইরাস যে সকল হোস্ট বা বাহককে (যেমন মানুষ) সংক্রমিত করে ঐ একই হোস্ট বা বাহকগুলিকে এই ভাইরাসের সংক্রমিত করার পদ্ধতি তুলনা করে পরে এই ভাইরাসের নাম দেওয়া হয় – “সার্স-কভ্ – ২” বা “সিভিয়র্ অ্যাকিউট্ রেস্পিরেটরি সিন্ড্রোম কোরোনাভাইরাস – ২”। ভাইরাসদের শ্রেণীবিন্যাস অনুযায়ী এই ভাইরাসটি যে ফ্যামিলি-র অর্ন্তভুক্ত অর্থাৎ “কোরোনাভিরিডে” ফ্যামিলি, তার অর্ন্তগত চারটি জিনাস্ হলো – “আলফা কোরোনাভাইরাস”, “বিটা কোরোনাভাইরাস”, “গামা কোরোনাভাইরাস” ও “ডেল্টা কোরোনাভাইরাস”। এই ভাইরাসের “আইডেন্টিটি কার্ড”-এ জিনাস্ হিসাবে “বিটা কোরোনাভাইরাস”-কে চিহ্ণিত করা হয়েছে। এছাড়াও এর সাবজিনাস্ হলো “সার্বিকোভাইরাস” ও স্পিসিস্ হলো “সিভিয়র্ অ্যাকিউট্ রেস্পিরেটরি সিন্ড্রোম রিলেটেড্ কোরোনাভাইরাস”।

সার্স-কভ্-২ ভিরিয়ন-কণার গঠন এবং মানবকোষে এর প্রবেশ-পদ্ধতি:

একটি সার্স-কভ্-২ ভিরিয়ন-কণার (যেকোন ভাইরাস বাহক দেহের বাইরে থাকলে বা বাহক দেহে দুই কোষের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থান করলে তাকে “ভিরিয়ন” বলে। বাহক-কোষে প্রবেশ করার পর তার নাম হয় “ভাইরাস”) ব্যাস ৫০ থেকে ২০০ ন্যানোমিটার। অন্যান্য বিটা কোরোনাভাইরাসদের মত সার্স-কভ্-২ এর কণাও চারটি স্ট্রাক্চারাল বা গঠনমূলক প্রোটিন নিয়ে তৈরি হয় – “স্পাইক্ প্রোটিন”, “এনভেলপ্ প্রোটিন”, “মেমব্রেন প্রোটিন” ও “নিউক্লিওক্যাপ্সিড্ প্রোটিন”। “নিউক্লিওক্যাপ্সিড্ প্রোটিন” ভাইরাসের “আর.এন্.এ.”-কে ধারণ করে। বাকি তিন প্রকার প্রোটিন একসাথে এই ভিরিয়ন-কণার বাইরের আবরণ বা এনভেলপ্ তৈরি করে।

সার্স-কভ্-২ –র মধ্যে মানবকোষের অ্যান্জিওটেনসিন কনভার্টিং এনজাইম – ২ (এ. সি. ই. – ২ উৎসেচক) এর সাথে যুক্ত হওয়ার এক বিশেষ প্রবণতা দেখা যায়। মানুষের ফুসফুসের টাইপ – ২ অ্যালভিওলার কোষে এই উৎসেচকের প্রাচুর্য্য রয়েছে। এছাড়াও গ্যাসট্রিক এপিথেলিয়াম, ডুওডিনাল এপিথেলিয়াম ও রেক্টাল এপিথেলিয়াম এর গ্রন্থিকোষগুলিতে এবং ক্ষুদ্রান্ত্রের এন্ডোথেলিয়াল কোষগুলি ও এন্টারোসাইট-এ এই উৎসেচকের প্রাচুর্য্য দেখা যায়। সার্স-কভ্-২ ভিরিয়ন তার এনভেলপ্-র “স্পাইক্ প্রোটিন”-র সাহায্যে মানবকোষের এ. সি. ই. – ২ উৎসেচকের সাথে যুক্ত হয় ও তারপর প্রধানত দুইভাবে ভিরিয়নটি মানবকোষের ভিতরে প্রবেশ করতে পারে –

ক) ভিরিয়নটি নিজের এনভেলপ্ ও  মানবকোষের মধ্যে অবস্থিত “এন্ডোসোম”-এর প্রাচীরের “ফিউশন্” বা “সংযোজন” ঘটিয়ে “এন্ডোসোম” (এন্ডোসোম হলো যেকোন ইউক্যারিওটিক কোষের মধ্যে অবস্থিত পর্দাঘেরা এক কুঠুরি)-এ প্রবেশ করতে পারে।

অথবা

খ) ভিরিয়নটি নিজের এনভেলপ্ ও  মানবকোষের কোষ পর্দার “ফিউশন্” ঘটিয়ে সরাসরি মানবকোষের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে।

ভাইরাসটি “আর.এন্.এ. ভাইরাস” হলেও আমাদের বহু পরিচিত আর.এন্.এ. ভাইরাসগুলির (যেমন : এইচ্.আই.ভি.) মত এটি নিজের “আর.এন্.এ.” কে “ডি.এন্.এ.”-তে পরিবর্তিত করে মানুষের কোষের “ডি.এন্.এ.”-তে তা মিশিয়ে দেয় না। বরং, এই ভাইরাস মানুষের কোষে প্রবেশ করার পর মানবকোষের নিজস্ব “বার্তাবহ  আর.এন্.এ.”-কে নিষ্ক্রিয় করে দিয়ে নিজের “আর.এন্.এ.” কে মানবকোষের “বার্তাবহ  আর.এন্.এ.”-র ভূমিকায় লাগিয়ে দেয়। আর মানবকোষের “রাইবোজোম” অঙ্গাণুটি কিছু টের না পেয়ে ভাইরাসের সেই “বার্তাবহ  আর.এন্.এ.”-র নিউক্লিয়টাইড ক্রম অনুসরণ করেই দুই প্রকার পলিপ্রোটিন তৈরি করে ফেলে। এদের মধ্যে একপ্রকার পলিপ্রোটিন ভেঙে গিয়ে যে ষোলো প্রকার “ননস্ট্রাক্চারাল প্রোটিন” তৈরি হয় তাদের মধ্যে কিছু প্রোটিন এমন আছে যারা ভাইরাসটির “আর.এন্.এ.”কে অনুকরণ করে “ট্রান্সক্রিপ্শন্”ও “রেপ্লিকেশন্” প্রক্রিয়ায় আরও অনেক ভাইরাস জন্ম দেওয়ার জন্য দরকারি অনেকগুলি “আর.এন্.এ.” হুবহু তৈরি করে দেয়।

 কোভিড – ১৯ রোগের লক্ষণ:

এখনও পর্যন্ত কোভিড – ১৯ রোগ-সংক্রমণের যতগুলি ঘটনা সামনে এসেছে সেগুলির মধ্যে কিঞ্চিৎ লক্ষণ ও প্রবল অসুস্থতা থেকে শুরু করে মৃত্যু, এই সব রকম উদাহরণই রয়েছে। আমরা জানি যে, যেকোন ক্ষতিকারক জীবাণু, রাসায়নিক পদার্থ বা বিকিরণের সংস্পর্শে আসার ঠিক যে সময় পরে মানুষের মধ্যে লক্ষণ দেখা যেতে শুরু করে; তাকেই “ইনকিউবেশন্ পিরিয়ড্” বলে। সার্স-কভ্-২ ভাইরাসের ক্ষেত্রে “ইনকিউবেশন্ পিরিয়ড্” মোটামুটি মার্স-কভ্ ভাইরাসের মতনই অর্থাৎ দুই থেকে ১৪ দিন। লক্ষণগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো –

  • জ্বর
  • কাশি
  • শ্বাসকষ্ট
  • পেশীতে ব্যথা

 কোভিড – ১৯ রোগের উপলক্ষণ:

সার্স-কভ্-২ ভাইরাস-সংক্রমণ ঘটার পর “ইনকিউবেশন্ পিরিয়ড্” শুরু হওয়ার আগেই কিছু উপলক্ষণ দেখা দিতে পারে, যেমন –

  • প্রতিনিয়ত বুকে ব্যথা
  • মুখমন্ডলে বা ঠোঁটে নীলচে ভাব

কোভিড – ১৯ রোগে যে সকল মানুষের অসুস্থ হওয়ার প্রবণতা বেশী:

কোভিড – ১৯ একটি নতুন রোগ। সম্ভাব্য লক্ষণ ও উপলক্ষণের পাশাপাশি এই রোগের ঝুঁকি সংক্রান্ত তথ্যগুলোও সম্পূর্ণরূপে আমাদের কাছে নেই। এই রোগে যে সমস্ত মানুষের অসুস্থ হওয়ার প্রবণতা প্রবলতর তাদের মধ্যে আছেন –

  • যাদের বয়স ৬৫ বছর বা তারও বেশী
  • যাদের ফুসফুস সম্বন্ধীয় রোগ বা সমস্যা বা অ্যাস্থমা আছে
  • যে সমস্ত মানুষ হৃদরোগে ভোগেন
  • যাদের ক্যান্সার রোগের চিকিৎসা বা অস্থি মজ্জা (বোন মারো) প্রতিস্থাপন হয়েছে বলে কিংবা অনিয়ন্ত্রিত এইড্স রোগ থাকার কারণে অথবা দীর্ঘদিন কর্টিকোস্টেরয়েড সেবন করার জন্য শরীরের অনাক্রম্যতা বা ইমিউনিটি দুর্বল হয়ে পড়েছে।
  • গর্ভবতী মহিলাদের উপর কোভিড – ১৯ রোগের অতিরিক্ত কি কুপ্রভাব থাকতে পারে তা এখনওপর্যন্ত পরিষ্কার না হলেও যেকোন ক্ষতিকারক ভাইরাস-সংক্রমণের ক্ষেত্রে তাদের অসুস্থ হওয়ার প্রবণতা খুব বেশী হয় বলে তাদের পর্যবেক্ষণে থাকা আবশ্যক।

কোভিড – ১৯ রোগ কিভাবে ছড়িয়ে পড়ে ?

 সার্স-কভ্-২ ভাইরাসটি প্রাকৃতিক অর্থাৎ প্রাকৃতিকভাবে কোন পূর্বসুরী ভাইরাসের আর্.এন্.এ.-র নিউক্লিয়টাইড ক্রমে পরিবর্তন হয়ে (যাকে আমরা প্রাকৃতিক মিউটেশন হিসাবে জানি) এই ভাইরাস এসেছে নাকি ভাইরাসটি কৃত্রিম অর্থাৎ মানুষের দ্বারা “জিন এডিটিং” প্রক্রিয়ায় কোন ভাইরাসের আর্.এন্.এ.-র নিউক্লিয়টাইড ক্রমে পরিবর্তনের মাধ্যমে এই ভাইরাসের জন্ম হয়েছে (যাকে আমরা বলি “জেনেটিকালি এঞ্জিনিয়ার্ড” ভাইরাস), সেই বিষয়টি বিতর্কিত।

কোন নির্দিষ্ট স্পিসিস বা সাবস্পিসিস-র জীবেরা খুব বেশী সংখ্যায় কোন নির্দিষ্ট প্যাথোজেনের (রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাস বা ব্যাক্টেরিয়া বা অন্য কোন জীবাণু) বাহক হলে ঐ স্পিসিস বা সাবস্পিসিস-কে ঐ প্যাথোজেনের “রিসার্ভয়ার পপিউলেশন্” বলে। এখন ঐ “রিসার্ভয়ার পপিউলেশন্” যদি কোন “নভেল হোস্ট পপিউলেশন্” বা এমন কোন স্পিসিস বা সাবস্পিসিস-র জীবেদের সংস্পর্শে আসে যারা আদৌ ঐ প্যাথোজেনের বাহক ছিল না, তাদের শরীরেও ঐ প্যাথোজেন প্রবেশ করে এবং এইভাবে একটি স্পিসিস বা সাবস্পিসিস থেকে আরেকটি স্পিসিস বা সাবস্পিসিসে কোন প্যাথোজেনের সংক্রমণ-পদ্ধতিকে “স্পিলওভার ইন্ফেক্শন” বলে। “নভেল হোস্ট পপিউলেশন্”-এ প্রবেশ করার পর প্যাথোজেনটি “নভেল হোস্ট পপিউলেশন্”-এ খুব বেশী ছড়াতে পারে বা ছড়াতে নাও পারে।

এই ভাইরাসের “রিসার্ভয়ার পপিউলেশন্” এখনও ঠিকমত জানা যায়নি তবে “স্পিলওভার ইন্ফেক্শন” এর মাধ্যমে পশুরা কোনভাবে এই ভাইরাসের “নভেল হোস্ট” হয়ে যায় এবং তারপর পশুদের শরীর থেকেই এই ভাইরাস প্রথম মানুষের শরীরে প্রবেশ করেছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।

মানুষে মানুষে সংক্রমণ

ছয় ফুট বা তার কম দূরত্বে থাকলে কোন সংক্রমিত ব্যক্তির হাঁচি বা কাশির সময় তার নাক বা মুখ নিঃসৃত তরলের ফোঁটা যা এই ভিরিয়নকে বহন করে; তা সুস্থ মানুষের নাক, মুখ বা চোখে এসে পড়ার সম্ভাবনা বেশী হয়। ফলে মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে।

সার্স-কভ্-২ ভিরিয়ন বহুল বস্তু বা পৃষ্ঠতল থেকে সংক্রমণ

চারপাশের পরিবেশের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য যেমন –  পি.এইচ্. (একটি জলীয় দ্রবণ কতটা আম্লিক বা ক্ষারীয় তা পরিমাপের একক) মান, বিভব বা ভোল্টেজ, ক্রোমোফোর-এ(কোন যৌগিক পদার্থের অণুতে উপস্থিত যে পরমাণু বা মূলকের জন্য যৌগিক পদার্থটি বিশেষ রঙ পায় তাকে “ক্রোমোফোর” বলে) আলোকরশ্মি পতিত হওয়া, আয়নের (চার্জ বা আধান সম্পন্ন কোন মৌলের পরমাণু বা মূলককে “আয়ন” বলে) ঘনত্ব, ফসফোরাইলেশন্ (কোন পদার্থের অণুর সাথে ফসফোরাইল মূলক যুক্ত হওয়ার রাসায়নিক বিক্রিয়া), কোন জৈব অণুর সাথে কোন জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে লিগান্ড যুক্ত হয়ে বেশী আণবিক গুরুত্বের জৈব অণু বা কম্প্লেক্স তৈরি হওয়া –  ইত্যাদির প্রভাবে প্রোটিনের মত বড় আকারের অণুর শেপ্ বা আকৃতির পরিবর্তন ঘটে ও যার ফলে অণুটি তার স্বাভাবিক সক্রিয়তা হারাতে পারে।

আগেই বলেছি যে, এই ভিরিয়নের এনভেলপ্; “স্পাইক্ প্রোটিন”, “এনভেলপ্ প্রোটিন”, “মেমব্রেন প্রোটিন”- এই তিন প্রকার প্রোটিন অণু দিয়ে তৈরি হয়। বাহক দেহের বাইরে দীর্ঘ সময় ধরে থাকার সময় সার্স-কভ্-২ ভিরিয়নের এনভেলপের প্রোটিনগুলি পরিপার্শ্বের প্রভাবে একই কারণে নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে পারে ও ফলে ভিরিয়নটি বাহক কোষে প্রবেশের ক্ষমতা হারায়। পরীক্ষাগত পর্যবেক্ষণ বলছে যে, এই ভিরিয়নগুলি তামার উপর আঠারো ঘণ্টা, কার্ডবোর্ডের উপর পঞ্চান্ন ঘণ্টা, স্টেইনলেস স্টীলের উপর নব্বই ঘণ্টা এবং প্লাস্টিকে একশো ঘণ্টারও বেশী সক্রিয় থাকে। সার্স-কভ্-২ ভিরিয়নকে এয়ারোসলে তিন ঘণ্টা সক্রিয় থাকতে দেখা গেছে। মানুষ ও পশুর মলেও এই ভাইরাসকে সক্রিয় থাকতে দেখা গেছে।

কোন বস্তু বা তলের উপর থাকা সার্স-কভ্-২ ভিরিয়নগুলির এনভেলপ্ যখন সক্রিয় অবস্থায় আছে, তখন সেই বস্তু বা তল স্পর্শ করার পর কোন ব্যক্তি নাক, মুখ বা চোখ স্পর্শ করলে তিনি সংক্রমিত হয়ে যেতে পারেন।

 কোভিড – ১৯ রোগ নিরাময়ের সম্ভাব্য পথের প্রস্তাব:

আমরা ইতিমধ্যে সার্স-কভ্-২ ভিরিয়নকে এড়িয়ে চলার বিভিন্ন পথ-নির্দেশ পেয়েছি। কিন্তু এই ভিরিয়ন শরীরে প্রবেশ করার পর কিভাবে এর কুপ্রভাব থেকে মুক্ত হওয়া যায় অর্থাৎ কোভিড -১৯ রোগ নিরাময়ের একটি সম্ভাব্য পথ নিয়ে এখন আলোচনা করব। আমরা জেনেছি যে সার্স-কভ্-২ ভাইরাস “সিভিয়র্ অ্যাকিউট্ রেস্পিরেটরি সিন্ড্রোম রিলেটেড্ কোরোনাভাইরাস” স্পিসিস-র অর্ন্তভুক্ত। আমি একটি সম্ভাব্য পথের প্রস্তাব রাখছি যে পথে শুধু সার্স-কভ্-২ ভাইরাস নয় বরং “সিভিয়র্ অ্যাকিউট্ রেস্পিরেটরি সিন্ড্রোম রিলেটেড্ কোরোনাভাইরাস” স্পিসিস-র সকল ভাইরাসের মানবকোষে বংশবৃদ্ধি আটকানো যেতে পারে আর বলাই বাহুল্য যে এই বংশবৃদ্ধি রোখা গেলে কোভিড -১৯ বা এই জাতীয় সকল রোগ নিরাময়ও সম্ভব হবে। “সিভিয়র্ অ্যাকিউট্ রেস্পিরেটরি সিন্ড্রোম রিলেটেড্ কোরোনাভাইরাস” স্পিসিস-র সকল ভাইরাস কিভাবে মানবকোষে বংশবৃদ্ধি করে সেই বিষয়টা প্রথমে বোঝা যাক্ –

“সিভিয়র্ অ্যাকিউট্ রেস্পিরেটরি সিন্ড্রোম রিলেটেড্ কোরোনাভাইরাস”-র মানবদেহে  বংশবিস্তারের পদ্ধতি

ভিরিয়ন কণা মানবকোষে প্রবেশের পর ভাইরাসের নিউক্লিওক্যাপ্সিড্ মানবকোষের সাইটোপ্লাজমে প্রবেশ করে ও সেখানেই ভাইরাসের “আর.এন্.এ.” নিউক্লিওক্যাপ্সিড্ থেকে মুক্ত হয়। ভাইরাস মানবকোষের নিজস্ব “মেসেঞ্জার  আর.এন্.এ.”-কে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। তখন মানবকোষের “রাইবোজোম” মানবকোষের মধ্যে কেবল ভাইরাসের “আর.এন্.এ.”-কে সক্রিয় হিসাবে পেয়ে “আর.এন্.এ.”-টির সমগ্র দৈর্ঘ্যের দুই তৃতীয়াংশে যে নিউক্লিয়টাইড ক্রম আছে তাকে অনুসরণ করে “ট্রান্সলেশন্” পদ্ধতিতে বড় আকারের দুই প্রকার পলিপ্রোটিন অণু (পলিপ্রোটিন অণু হলো অনেকগুলি অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের প্রোটিন অণু একে অপরের সাথে সমযোজী বন্ধনের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে তৈরি হওয়া একটি দীর্ঘ শৃঙ্খলের মত অণু) তৈরি করে – “পি.পি.১এ” ও “পি.পি.১এ বি”।

প্রতিটি পলিপ্রোটিন অণুতে বা শৃঙ্খলে তিন রকম এন্জাইম বা উৎসেচক অণু থাকে – “প্রোটিজ”, “পি.এল.প্রো.” বা “পাপাইন সদৃশ প্রোটিনেজ” এবং “৩সি.এল.প্রো” যারা পলিপ্রোটিন অণুকে ভাঙতে সাহায্য করে। “পি.পি.১এ বি” পলিপ্রোটিনটি ভেঙে ষোলো প্রকার “ননস্ট্রাক্চারাল প্রোটিন” তৈরি হয় – “এন.এস্.পি ১”, “এন.এস্.পি ২”,………,“এন.এস্.পি ১৬”। এই “ননস্ট্রাক্চারাল প্রোটিন”-গুলির মধ্যে কিছু প্রোটিন “রেপ্লিকেশন্ প্রোটিন” হিসাবে কাজ করে বলে তাদের “ননস্ট্রাক্চারাল রেপ্লিকেশন্ প্রোটিন” বলে। আবার “ননস্ট্রাক্চারাল রেপ্লিকেশন্ প্রোটিন”-গুলির মধ্যে কিছু প্রোটিন একে অপরের সাথে যুক্ত হয়ে বহু প্রোটিণ অণু সমন্বিত “রেপ্লিকেজ-ট্রান্সক্রিপ্টেজ কমপ্লেক্স” তৈরি করে। এই কমপ্লেক্সে উপস্থিত প্রধান “রেপ্লিকেজ-ট্রান্সক্রিপ্টেজ” প্রোটিনটি হলো “আর্.এন্.এ. ডিপেন্ডেন্ট  আর্.এন্.এ. পলিমারেজ” বা “এন.এস্.পি ১২” যা ভাইরাসের “ট্রান্সক্রিপ্শন্” ও “রেপ্লিকেশন্” প্রক্রিয়ায় প্রধান ভূমিকা নেয়। তবে কমপ্লেক্সটিতে উপস্থিত বাকি “ননস্ট্রাক্চারাল প্রোটিন”-গুলিও “ট্রান্সক্রিপ্শন্” ও “রেপ্লিকেশন্” প্রক্রিয়াটিতে সাহায্য করে থাকে। এই “ট্রান্সক্রিপ্শন্” ও “রেপ্লিকেশন্” প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই ভাইরাসের “আর.এন্.এ.”-টিকে হুবহু নকল করে পরবর্তী প্রজন্মের ভাইরাসের জন্য নতুন “আর.এন্.এ.” তৈরি হয়।

  এই প্রসঙ্গে বলে দিই যে, “এন.এস্.পি ১”প্রোটিন ও “পাপাইন সদৃশ প্রোটিনেজ” উৎসেচক বা এন্জাইম মানুষের শরীরের ইমাউনিটি-কে দুর্বল করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। এছাড়াও “এন.এস্.পি ১”প্রোটিনটি মানবকোষের নিজস্ব “মেসেঞ্জার আর.এন্.এ.”-কে ধ্বংস করা ও মানবকোষের স্বাভাবিক “ট্রান্সলেশন্” প্রক্রিয়াতে বাধা দেওয়ায় অন্যতম হোতা।

“সিভিয়র্ অ্যাকিউট্ রেস্পিরেটরি সিন্ড্রোম রিলেটেড্ কোরোনাভাইরাস” দ্বারা সংক্রমিত মানবকোষে তৈরি হওয়া “পাপাইন সদৃশ প্রোটিনেজ” উৎসেচককে প্রতিরোধ করা

“পাপাইন” উৎসেচকটি প্রধানত কাঁচা পেঁপে থেকে পাওয়া যায়। এটি বিভিন্ন খাদ্য ও ওষুধ শিল্পে যেমন অস্পষ্ট লেন্স পরিষ্কার করা, মাংস নরম করা, উন্ড অ্যাঢেশন-র লাইসিস প্রক্রিয়া, হাইম্যানোপ্টেরা ও জেলিফিশ-র কামড় চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও জোলাপ, টুথ পাউডার, হজমের বড়ি ও স্কিন লোশন শিল্পে অ্যাডিটিভ্ বা যোজনীয় হিসাবে “পাপাইন” উৎসেচকটি ব্যবহৃত হয়। বহু মানুষ যারা এই সকল শিল্পে কর্মী হিসাবে জীবিকা নির্বাহ করেন, তাদের “পাপাইন” উৎসেচকের সংস্পর্শে আসতে হয় এবং তাদের অনেককেই শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথা, কাশি ইত্যাদি শারীরিক অসুস্থতা সহ্য করতে হয় যেগুলি “কোভিড – ১৯” রোগের লক্ষণ ও উপলক্ষণগুলির মধ্যে পড়ে। সুতরাং “কোভিড – ১৯” রোগীদের মধ্যে যে শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথা ও কাশি দেখা যায়; তার কারণ হতে পারে তাদের সংক্রমিত কোষে ভাইরাস উৎপাদিত “পাপাইন সদৃশ প্রোটিনেজ” উৎসেচকের উপস্থিতি। যদি আমরা “কোভিড – ১৯” রোগীদের শরীরে “পাপাইন সদৃশ প্রোটিনেজ” এনজাইমের অ্যান্টি-এনজাইম (অ্যান্টি-এনজাইম্ হলো কোন পদার্থ বিশেষত অ্যান্টিবডি বা কোন এনজাইম্ যা অপর কোন এনজাইমের ক্রিয়াকে প্রতিরোধ করে) প্রয়োগ করে “পাপাইন সদৃশ প্রোটিনেজ” এনজাইম-র ক্রিয়াকে প্রতিরোধ করতে পারি, তবে “পি.পি.১এ বি” পলিপ্রোটিন অণু ভেঙে “ননস্ট্রাক্চারাল প্রোটিন”-গুলি তৈরি হতে পারবে না ও ফলে ভাইরাসের বংশবৃদ্ধিও বন্ধ হতে পারে। “পাপাইন”এনজাইম নির্ভরশীল যে শিল্পগুলো ইতিমধ্যে উল্লেখ করেছি, সেখানে দীর্ঘদিন কর্মরত কিছু মানুষের শরীরে এই ধরনের অ্যান্টি-এনজাইম্ তৈরি হয়ে থাকতে পারে, তবে তা পরীক্ষা ও খতিয়ে দেখার বিষয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are makes.