ঢাকায় ৪০ মিনিটে ১টি তালাক

  • দেশে সংসার ভেঙে যাওয়ার সংখ্যা বাড়ছে। বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যা রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি।

সারা দেশে বিবাহবিচ্ছেদ বাড়ছে। গত বছর রাজধানীতে তালাক হয়েছে প্রতিদিন ৩৭টি করে।বিচ্ছেদের আবেদন নারীরা বেশি করছেন। নির্যাতন-পীড়ন থেকে আত্মমর্যাদাবান নারীরা তালাকে খুঁজছেন মুক্তি। বিচ্ছেদের আবেদনের পর সমঝোতা হয়েছে খুবই কম—৫ শতাংশের নিচে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এবং জেলা রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে বিবাহবিচ্ছেদের এই চিত্র পাওয়া গেছে।

ঢাকার দুই সিটির মেয়রের কার্যালয়ের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০২২ সালে তালাকের আবেদন এসেছিল মোট ১৩ হাজার ২৮৮টি। এর মধ্যে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৭ হাজার ৬৯৮টি, উত্তর সিটিতে ৫ হাজার ৫৯০টি। এ হিসাবে রাজধানীতে প্রতিদিন ভেঙে যাচ্ছে প্রায় ৩৭টি দাম্পত্য সম্পর্ক, অর্থাৎ তালাকের ঘটনা ঘটছে ৪০ মিনিটে ১টি করে। আর চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে আবেদনের সংখ্যা ২ হাজার ৪৮৮।

বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন এখনো চলমান। এ আইন অনুযায়ী, রাজধানীতে তালাকের আবেদন পাঠাতে হয় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়রের কার্যালয়ে। আবেদন প্রথমে সেখানে নথিবদ্ধ হয়। মূলত স্ত্রী যে ঠিকানায় থাকেন, আবেদনটি সেখান থেকে পাঠানো হয় সে অঞ্চলের কার্যালয়ে।

আপস যৎসামান্য

বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়লে কর্তৃপক্ষ আবেদনকারী ও বিবাদী—দুই পক্ষকেই আপসের নোটিশ পাঠায়। দুই পক্ষে সমঝোতা না হলে কর্তৃপক্ষের আর কোনো দায়িত্ব থাকে না। আবেদনের ৯০ দিনের মধ্যে কোনো পক্ষ আপস না করলে বা আবেদন তুলে না নিলে তালাক কার্যকর হয়ে যায়।

সিটি করপোরেশন এলাকায় এ ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ হচ্ছেন আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তারা। তাঁরা আপসের নোটিশ পাঠান। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে গত বছর তালাকের আবেদন জানিয়েছিলেন ৫ হাজার ৫৯০ জন। আপস হয়েছে মাত্র ১২৮টি। আবেদনের তুলনায় আপস ২ শতাংশের মতো।

সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে স্বামী বা স্ত্রী সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে তালাকের আবেদন করেন। স্ত্রী বা স্বামী—কারও আবেদনের নোটিশে সাধারণত অপর পক্ষ আসে না। দুই পক্ষ কখনো এলেও আপস করার মতো পরিস্থিতি থাকে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ৯০ দিন পর তালাক কার্যকর হয়ে যায়।

ঢাকার বাইরের ছবিও আলাদা কিছু নয়। বরিশাল সিটি করপোরেশন পূর্ণাঙ্গ তথ্য দিতে পারেনি। তাদের দেওয়া আংশিক তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ ১৯৭টি তালাকের আবেদনে আপসের চেষ্টা করে সফল হয়েছে মাত্র ৪টিতে। এই হারও ২ শতাংশ।

২০২০ ও ২০২১ সালেও রাজধানীতে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদনের সংখ্যা ছিল ১২ হাজারের বেশি। ঢাকার দুই সিটির মেয়রের কার্যালয়ের তথ্য অনুসারে, এই দুই বছরে আবেদন জমা পড়েছে যথাক্রমে ১২ হাজার ৫১৩ এবং ১৪ হাজার ৬৫৯টি। গত চার বছরে তালাক হয়েছে ৫২ হাজার ৯৬৪টি।

বিবাহবিচ্ছেদ যে কয়েক বছর ধরে বাড়ছে, তা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যেও দেখা যায়। বেশি বাড়ছে শিক্ষিত দম্পতিদের মধ্যে। বিবিএসের ২০২১ সালের ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৫ বছর ধরে তালাকের হার ঊর্ধ্বমুখী। সবচেয়ে বেশি রাজশাহী বিভাগে, কম সিলেটে।

‘বনিবনা না হওয়া’

তালাকের আবেদনের ছক আইনজীবীদের কাছে প্রস্তুত অবস্থাতেই থাকে। শুধু বিভিন্ন পক্ষের নাম-পরিচয়-ঠিকানাই পাল্টে যায়। বাকি সব এক। হঠাৎ দু–একটি ক্ষেত্রে সামান্য হেরফের হয়। সিটি করপোরেশনের আবেদনগুলোতে তাই বিবাহবিচ্ছেদের জন্য দেখানো কারণগুলো একেবারেই গৎবাঁধা।

প্রায় সব আবেদনেই বিচ্ছেদের কারণ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ‘বনিবনা না হওয়া’। এর বাইরে আছে পারিবারিক কলহ, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, যৌতুক, মাদক সেবন করে নির্যাতন, প্রবাসী স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা, যৌন অক্ষমতা, সন্দেহ, উদাসীনতা, ব্যক্তিত্বের সংঘাতসহ আরও কিছু অভিযোগ।

গত বছর বিবাহবিচ্ছেদ হওয়া রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার এক নারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের বিয়ে হয়েছিল পারিবারিক আয়োজনে। ভিন্ন ভিন্ন মনমানসিকতা সত্ত্বেও সংসার চলে যাচ্ছিল। কিন্তু বছর কয়েক পর স্বামী অন্য মেয়ের প্রতি দুর্বল হয়ে তালাক দিলেন।’ তাঁদের তিন বছরের একটি কন্যা রয়েছে। এখন পারিবারিক আদালতে মামলা চলছে ভরণপোষণ নিয়ে।

user-1+2

all author posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are makes.