জালের সঙ্গে বিচ্ছেদ মেসির

লিওনেল মেসি

অথচ শিরোনামটা অদৃশ্যভাবে ছিল উল্টো—পোস্টের সঙ্গে বিচ্ছেদ, জালের সঙ্গে প্রেম লিওনেল মেসির! প্রেমের আগে চাইলে সঙ্গে ‘বেজায়’ শব্দটা জুড়ে দিতে পারেন।

তা নয় তো কী! মেসির ক্যারিয়ার ও ফুটবলের রূপান্তরে তাকালেই বোঝা যায় ব্যাপারটি। ২০০৪-০৪ মৌসুমে বার্সেলোনার হয়ে লা লিগায় শুরু করলেও আর্জেন্টাইন আড়মোড়া ভেঙেছেন ২০০৮-০৯ মৌসুমে ৩৮ গোল করে! অথচ তখনকার বাস্তবতা ছিল মৌসুম শেষে কোনো স্ট্রাইকারের নামের পাশে ২০-২৫ গোল থাকলেই দুর্দান্ত।

গোল করার এ ভাষা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর সঙ্গে মিলে পরের প্রায় এক দশকের বেশি সময়ে পাল্টে দিয়েছেন মেসি। এখন মৌসুম শেষে স্ট্রাইকারদের নামের পাশে অন্তত ৩৫-৪০ গোল না থাকলে তাঁকে অনেকে স্ট্রাইকারই মানবেন না!

অথচ মেসি কি নিখাদ স্ট্রাইকার? না, গোল করা ও করানোর কাজটা ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই করে যাচ্ছেন বার্সেলোনা ছেড়ে গত মৌসুমে পিএসজিতে যোগ দেওয়া আর্জেন্টাইন। এ ভূমিকাতেই মৌসুমের পর মৌসুম ধরে গোল করার সংখ্যাটা মেসি এমন জায়গায় তুলেছেন যে তাঁর গোল করার পারফরম্যান্সকে অনেকে স্ট্রাইকারদের ভালো করার রেফারেন্স পয়েন্ট হিসেবে ধরেন। সেটি সম্ভব হয়েছে, প্রতিপক্ষের গোলপোস্টের জালের সঙ্গে মেসির বেজায় ‘প্রেমে’র কারণেই। নইলে এক পঞ্জিকাবর্ষে সর্বোচ্চ ৯১ গোলের রেকর্ড তিনি গড়তে পারতেন না।

কিন্তু কথায় আছে না, বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না, দূরেও ঠেলে দেয়। মেসিরও নিশ্চয়ই এখন এমন সময় যাচ্ছে। সেটা কি তাঁর ৩৪ বছর বয়সের কারণে? এ নিয়ে বিতর্ক হতে পারে।

তবে বিতর্ক হবে না তাঁর গোল করার হার কমে যাওয়া নিয়ে; সেই সঙ্গে গোল করানোর হারও কমেছে। বার্সেলোনায় সোনা ফলিয়ে পিএসজিতে যোগ দেওয়া এই ফরোয়ার্ড নিজেও হয়তো এই খরা টের পাচ্ছেন।

ফ্রেঞ্চ লিগ আঁ–তে এখনো দুই ম্যাচ বাকি পিএসজির। লিগে ২৪ ম্যাচ খেলা মেসির গোলসংখ্যা মাত্র ৪, সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৩২ ম্যাচে ৯ গোল—এই পরিসংখ্যান মেসির নামের পাশে আর যা–ই হোক মানানসই হতে পারে না। বার্সা ছাড়ার আগে শেষ দুই মৌসুমেও তাঁর গোলসংখ্যা ছিল ৩১ ও ৩৮।

অর্থাৎ জালের সঙ্গে মেসির প্রেম তখনো ছিল, কিন্তু ঠিকানা পাল্টানো মানে পিএসজিতে যোগ দেওয়ার পরই জালের সঙ্গে মেসির কীভাবে যেন বিচ্ছেদ ঘটে গেল!
জাত ফুটবলাররা যেমন হয়ে থাকেন, মেসিও তেমনি জালের সঙ্গে তাঁর ‘হারানো প্রেম’ ফিরে পেতে মরিয়া।

বিষয়টি একটু কল্পনার চোখে দেখলে বুঝতে সুবিধা হবে। পোস্টের একদম বাইরে বল মারা যদি হয় চূড়ান্ত বিচ্ছেদের প্রতিশব্দ, তাহলে পোস্টে বল মারা তো এক অর্থে সেই বিচ্ছেদ থেকে ফিরে আসার চেষ্টাই? মেসি সেই চেষ্টা করতে করতেই একটি রেকর্ড গড়ে ফেলেছেন।

লিগ আঁ-তে রোববার ত্রয়ার বিপক্ষে ২-২ গোলে ড্র করে আগেই শিরোপা নিশ্চিত করে পিএসজি। এ ম্যাচসহ টানা তিন ম্যাচে গোলখরায় রইলেন মেসি। কিন্তু চেষ্টা যে করেননি, তা নয়। ত্রয়ার বিপক্ষেই গোল করতে গিয়ে দুবার বল মেরেছেন পোস্টে!
এ মৌসুমে সতীর্থদের দিয়ে ১৩ গোল করানো মেসি কতবার পোস্ট কাঁপালেন, তা শুনলে হতাশায় হেসে ফেলাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। ১০ বার!

গোল করা একসময় যাঁর কাছে ছিল মুড়িমুড়কি, সেই একই খেলোয়াড় বল ১০ বার পোস্টে মারলে ভ্রুকুটি জাগাই স্বাভাবিক। আর রেকর্ডটাও অনাকাক্ষিত, কিন্তু চোখ রগড়ে দেওয়ার মতো। ফুটবলের তথ্য-উপাত্তভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘অপটা’২০০৬-০৭ মৌসুম থেকে খেলোয়াড়দের বল পোস্টে মারার হিসেব সংরক্ষণ শুরু করে। সে সময় থেকে এখন পর্যন্ত লিগ আঁ-তে এক মৌসুমে এটাই সর্বোচ্চসংখ্যকবার বল পোস্টে মারার রেকর্ড, সেটা এ মৌসুমেই গড়লেন মেসি।

ইউরোপে শীর্ষ পাঁচ লিগ বিচারেও এ মৌসুমে বল পোস্টে মারার রেকর্ডের শীর্ষে মেসি। ৯ বার বল পোস্টে মেরে দুইয়ে বুন্দেসলিগায় ৩৩ ম্যাচ খেলা বায়ার্ন মিউনিখ স্ট্রাইকার রবার্ট লেভানডফস্কি। ৩৩ ম্যাচে ৭ বার বারে-পোস্টে বল লাগিয়ে তিন নম্বরে ইংলিশ ক্লাব ব্রেন্টফোর্ডের ব্রায়ান এমবুয়েমো।

এবার লিগ আঁ-তে সর্বোচ্চ ২৪ গোল করা মেসির ক্লাব সতীর্থ পিএসজি তারকা কিলিয়ান এমবাপ্পে বল পোস্টে মেরেছেন ৫ বার। অর্থাৎ মেসির ফিরে আসার চেষ্টায় কোনো ত্রুটি নেই, বরং চেষ্টাটা একটু বেশি করতে গিয়েই সম্ভবত নিখুঁত হতে পারছেন না। আরেকটু খুঁতহীন হতে পারলেই হয়তো মেসি ফিরে পেতে পারেন তাঁর ‘হারানো প্রেম’—প্রতিপক্ষের জাল!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are makes.