প্রথম বৈদ্যুতিক বাল্ব তৈরিতে লেগেছিল বাঁশ

পরিবেশ রক্ষায় বাঁশের ভূমিকা

‘বাঁশ’ শব্দটিকে বাংলাদেশে নেতিবাচক অর্থে ব্যবহার করা হলেও প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় এর ভূমিকা অপরিসীম।

সেইসাথে এর অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্য উপকারিতাও রয়েছে।

বিশ্বব্যাপী এই উদ্ভিদটি সংরক্ষণে নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ।

অথচ ভীষণ প্রয়োজনীয় বাঁশের আবাদ বা রক্ষণাবেক্ষণে তেমন কোন যত্নেরই প্রয়োজন হয় না।

চীনা সভ্যতায় বাঁশ শুভ শক্তির প্রতীক। বাড়ির আশপাশে বাঁশ গাছ লাগানো তাদের ঐতিহ্য। বাঙালির জীবনে বাঁশ বহুবিধ কাজে লাগে। দোলনা থেকে কবর অবধি। বাঁশের কুটির শিল্প ঘরের শোভা বৃদ্ধি করে। মই, চাটাই, ঝুড়ি, লাঙ্গলের অংশ, মঞ্চ নির্মাণ ইত্যাদির কাঁচামাল বাঁশ। বাঁশ দিয়ে তৈরি বিভিন্ন পণ্য যেমন পার্টিকেল বোর্ড, সিমেন্ট ব্যান্ডেড পার্টিকেল। সুতা এবং কাগজ তৈরিতে বাঁশের ব্যবহার অনেক আগে থেকে। বাঁশের তৈরি বিভিন্ন জিনিস বিদেশে রপ্তানি হয়। দেশ অর্জন করে বৈদেশিক মুদ্রা।

বাঁশের পাতায় ঘরের ছাউনি হয়; আবার বাঁশের পাতা উত্তম গোখাদ্য। ঝড়-ঝঞ্ঝা থেকেও বাঁশ রক্ষা করে। বসতবাড়ির পাশে তাই গ্রামে বাঁশঝাড় দেখা যায়। পার্বত্য অঞ্চলের মানুষ বাঁশ রান্না করে খায়। সে খাবার বেশ মুখরোচক। চীন, থাইল্যান্ড, মিয়ানমারে বাঁশের সবজি খুব জনপ্রিয়। ওই সব দেশের মানুষ বাঁশের সবজি খেতে পছন্দ করে। সম্প্রতি দেশে রডের বদলে বাঁশের ব্যবহার ধরা পড়ায় চমক সৃষ্টি হয়েছে। নির্মাণ কাজে বাঁশের সিলিংয়ের বিকল্প আমাদের দেশে সহজলভ্য নয়। বাণিজ্যিকভাবে বাঁশ গাছের চাষ সম্ভব। চাঁদপুর, সিলেট, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন স্থানে বাঁশের বাণিজ্যিক আবাদ হচ্ছে। চাহিদা প্রচুর। শুধু নির্মাণকাজে শত শত টন বাঁশের প্রয়োজন হয়। বাণিজ্যিকভাবে বাঁশের খামারি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন জানান, বারো বিঘা জমিতে বাঁশের খামার করে বছরে তার ইনকাম কমপক্ষে ২০ লাখ টাকা। কাটিং পদ্ধতিতে খুব সহজেই বাঁশের চারা সংগ্রহ সম্ভব। মাঝে মধ্যে পানি দেওয়া একটুকুনই বাঁশের পরিচর্যা। দু’একটি প্রজাতির বাঁশ গাছে আগামোরা রোগ হয়। পৃথিবীতে ৩শ’ প্রজাতির বাঁশ রয়েছে। বাংলাদেশে ৩৩ প্রজাতির মতো বাঁশ দেখা যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মুলি, মিতিয়া, ছড়ি, আইক্কা, বাইজা, বররা, মাকাল ও তল্লা বাঁশ। চীনে আছে ৫০০ প্রজাতির বাঁশ।

ব্রাজিলে আছে ২৩২ প্রজাতির বাঁশ। বাঁশ গাছে ফল ধরে না। ফুল হয় কদাচিৎ। বহুদিন পরপর। দশ থেকে একশ বিশ বছরের চক্রে ফুল আসতে পারে। বাঁশের অধিকাংশ প্রজাতি ফুল প্রদানের পরে মৃত্যুবরণ করে। বাঁশ হলো ঘাস জাতীয় উদ্ভিদ। বাসা-বাড়ির কাজে বাঁশের ব্যাপক ব্যবহারের কারণে একে গরিবের দারুবৃক্ষ বলা হয়। পৃথিবীর অনেক দেশে অবশ্য বাঁশকে বলা হয় মিরাকল প্লান্ট। হাজারটা উপকার করলেও বাঁশ বড় অবহেলিত। বাঁশ নিয়ে ভালো সাহিত্যকর্ম নেই। খারাপ উপমায় বাঁশকে টেনে আনা হয়। কেউ কারও ক্ষতি করলে বলা হয়, ওমুক তমুককে বাঁশ দিল। বাঁশ ঝাড়ে ভূত পেত্নি আছে। এমনটা বলে বাচ্চাদের ভয় দেখিয়ে খাওয়ানো হয়। বাতাস এলে বাঁশঝাড়ে শোঁ শোঁ শব্দ হয়। মূলত পাতার সঙ্গে পাতার লেগে যাওয়ায় এমনটা হয়। প্রকৃত অর্থে বাঁশ খুব নিরীহ প্রজাতির উদ্ভিদ। বাঁশ প্রচুর অক্সিজেন সরবরাহ করে থাকে। মানবজীবন, পরিবেশ, প্রকৃতি রক্ষায় বাঁশের অবদান বলে শেষ করা যাবে না। আজকাল শহরে বাড়ির ছাদে, সামনে বাঁশ গাছ দেখা যায়। অবশ্যই এটা আমাদের জন্য ভালো খবর।
বাঁশের ঘর ভূমিকম্পন সহনশীল। জাপানে প্রচুর বাঁশের ঘর দেখা যায়। বিশে^র প্রায় এক বিলিয়ন মানুষ বাঁশের ঘরে বসবাস করে। আজকের দিনে বৈদ্যুতিক বাল্বের আলোয় আলোকিত ঘরদোর। এই বৈদ্যুতিক বাল্ব আবিষ্কারের নেপথ্যে বাঁশের অবদান আছে। টমাস আলভা এডিসন প্রথম বৈদ্যুতিক বাতির মধ্যে বাঁশের ফিলামেন্ট ব্যবহার করেন।

১৯৪২ সালের কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। ইংরেজদের মনে আশঙ্কা হলো জার্মানি, জাপান তাজমহলের ওপর বোমাবর্ষণ করতে পারে। তাই তারা বুদ্ধি করে বাঁশের ছাউনি দিয়ে তাজমহলের চূড়া ঢেকে দিয়েছিল।

বাঁশ নিয়ে প্রাচীন প্রবাদ হলো, কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ পাকলে করে ঠাসঠাস। কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বাঁশ এসেছে- তলতা বাঁশের ছিপ হাতে রবে মাছ আমি ধরিব না কিছু। যে হারে বাঁশ কাটা হয় তার সিকিভাগও লাগানো হয় না। গ্রামগঞ্জে গেলে এখন ঘন বাঁশঝাড় চোখে পড়ে কমই। বাড়ির পাশে পুকুর ধারে বাঁশঝাড়। ঝড়ের সময় শোঁ শোঁ শব্দ। বাঁশ গাছের মাথা নুইয়ে পড়া আবার উঠে যাওয়া। পাখপাখালির কলরব। কতই না সুন্দর দৃশ্য। মনপ্রাণ কেড়ে নেওয়ার মতো পরিবেশ। অবশ্য এসব ক্রমেই ধূসর স্মৃতিতে পরিণত হচ্ছে। এককালে হয়ে যাবে সব গল্প। এক সময় যা সবই ছিল চোখে দেখা সত্য।

বনকাক, বুলবুলি, শালিক, ফিঙের মতো পাখির নিরাপদ আশ্রয় বাঁশঝাড়। কাঠবিড়ালী, ইঁদুর, গিরগিটি, মাকড়সা, পিঁপড়া, কিছু সাপ বাঁশঝাড়ে বাসা বাঁধতে পছন্দ করে। গোয়ালে লতা, গুল্ম’র মতো কিছু উদ্ভিদ বাঁশঝাড়ে জন্মায়। এসব কারণে জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বাঁশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিছুদিন আগে পার্বত্য অঞ্চলে বাঁশের উৎপাদন বাড়াতে ২৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় ১৩ হাজার বাঁশবাগান সৃজন করা হবে। পাহাড়ে ধস অতঃপর অসংখ্য মানুষের মৃত্যু, এমন খবর নতুন নয়।

বাঁশ ভূমি ধস রোধ করে; ভূমির মান উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। বাঁশের বাশির সুর টেনে নিয়ে যায় বহুদূর। প্রখ্যাত বংশীবাদক বারী সিদ্দিকী বাঁশের বাঁশি বাজিয়ে বিশ^কে মুগ্ধ করেছেন। ১৯৯৯ সালে বিশ^ বাঁশি সম্মেলনে তিনি অংশ নেন। ভারতীয় উপমহাদেশের একমাত্র প্রতিনিধি ছিলেন তিনি। বাঁশির সুরে তিনি সবাইকে মুগ্ধ করেন। তিরি দরদ মাখানো কণ্ঠে গেয়েছেন- আমার অনেক বাঁশের বাঁশি আছে, মিছে কেন কিনবি চাটাই বাঁশ…। উপকারি দিকগুলো যদি দেখা হয় তাহলে নীতিবাচক অর্থে বাঁশ শব্দটির ব্যবহার যুৎসই হয় না। বরং যেখানে সুযোগ আছে সেখানে বাঁশ গাছ রোপণ করা উত্তম। পরিবেশ, প্রকৃতি তথা মানব সমাজের জন্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are makes.